আর রাহীকুল মাখতুম কোন প্রকাশনী ভালো | Which publication's Ar Rahikul Makhtum is best in Bangladesh?
আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন পুরো মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত। তিনি আল্লাহর প্রদত্ত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের প্রতিটি বিধি বিধান অনুসরনের মাধ্যমে এমন এক আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন যা সকল মানুষের অবশ্য অনুসরনীয় ও অনুকরনীয়। তাছাড়া মুসলিম হিসেবে রাসুল (সাঃ) কে নিজের জান, মাল, পরিবার সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসা জরুরি, তা ব্যতিত প্রকৃত মুমিন হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
কিন্তু কাউকে ভালভাবে না চিনে, তার সম্পর্কে ভাল মত না জেনে তাকে নিজের জীবনের চেয়ে ভালবাসা কখনই সম্ভব নয়। তিনি কিভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন, তার চলাফেরা, কথাবার্তা কেমন ছিল এগুলো না জেনে তাকে অনুসরন করাও সম্ভব নয়।
রাসুল (সাঃ) সম্পর্কে জানতে, তার আচার, আখলাক, চরিত্র, তার পুরো জীবনের ভিবিন্ন ঘটনাপ্রবাহগুলো বুঝতে হলে তার সিরাত পাঠ অত্যন্ত জরুরী।
নবীজির সিরাত গ্রন্থের কথা আসলেই যে গ্রন্থটির নাম সর্বপ্রথম চলে আসে সেটি হলঃ আর রাহীকুল মাখতুম।
আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরীর লেখা আর রাহীকুল মাখতুম বইটি নবীজি (সাঃ) এর জীবনি নিয়ে লেখা একটি শ্রেষ্ট সিরাত গ্রন্থ। এই বইটি ১৯৮৭ সালে রাবেতা আল-আলম আল ইসলামী কর্তৃক আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতায় ১১৮২টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এটি সিরাতের ওপর রচিত অতীতের শত শত গ্রন্থের মৌলিক ও নির্ভরযোগ্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এক কথায় সিরাত সংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাস গ্রন্থ।
বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইন প্রত্যক জায়গায় বিভিন্ন ভাবে এই বইটি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। যার ফলে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মুসলিম পাঠকদের মধ্যে এই বইটির ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষনীয়। এই বইটি মুলত আরবি ভাষায় লেখা এবং বাঙ্গালি হিসেবে আমরা যেহেতু আরবি ভাষা বুঝি না তাই আমাদের জন্য বইটির বাংলা অনুবাদ পড়ায় হচ্ছে একমাত্র উপায়।
বাজারে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বিভিন্ন লেখক গ্রন্থটির অনুবাদ গ্রন্থ বের করেছেন। আর এখানেই সমস্যার উৎপত্তি, বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন ভাবে বইটির অনুবাদ করায় সেই অনুবাদ গুলোর মধ্যে উপস্থাপন, ব্যাকরণ, শব্দ চয়ন ইত্যাদি বিষয়ের ভিন্নতা দেখা যায়। যার ফলে পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়ে যান কোন বইটা তাদের কেনা উচিত।
সকল পাঠকদের রুচি এক রকম নয়, তাছাড়া সকলের চিন্তা, ভাবনা, মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা ইত্যাদি ও এক নয়। এর ওপর বাজারে অনেক মান সম্পন্ন বই যেমন আছে তার পাশাপাশি মানহীন বই এর ও কোন অভাব নেয়।
এ সকল কিছু বিবেচনা করে আজকের এই আর্টিকেল এ আমি বাজারের সেরা দুইটি প্রকাশনীর বই নিয়ে আলোচনা করবো। বইগুলোর প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য, সুবিধা, অসুবিধা ইত্যাদি পড়ে আপনি নিজের বিবেচনায় যেটা আপনার জন্য উপযুক্ত সেটা সংগ্রহ করতে পারবেন। ইনশাল্লাহ।
বিঃদ্রঃ এই আর্টিকেল এ আমি যে দুটো বই কে নিয়ে আলোচনা করছি এবং বিশ্লেষণ গুলো তুলে ধরছি এগুলো একান্তই আমার নিজস্ব মতামত। তাই আমার মতামত নেওয়ার পর আপনার নিজস্ব বিবেক, বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনে আরো যাচাই বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহন করুন এবং আপনার জন্য উপযুক্ত বইটি সংগ্রহ করুন।
আর রাহীকুল মাখতূম বা মোহরাঙ্কিত জান্নাতী সুধা (তাওহীদ প্রকাশনী)
তাওহীদ প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত এই অনুবাদটি অনুবাদ করেছেন আব্দুল খালেক রহমানী (সাবেক উপাধ্যক্ষ, কামারখন্দ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা, সিরাজগঞ্জ), মুয়ীনু্দ্দীন আহমাদ (প্রভাষক, রাজশাহী ইউনিভার্সিটি কলেজ, রাজশাহী)।
এই অনুবাদটি ১৯৯৪ সালের বর্ধিত ও সংশোধিত সংস্করণের আলোকে মুদ্রিত। বর্তমানে বাজারে আর রাহীকুল মাখতুম এর অনেক অনুবাদ বই পাওয়া গেলেও তাওহীদ প্রকাশনীর এই অনুবাদটি বাংলা ভাষায় অনুবাদকৃত বইগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে ছাপানো হয়েছে। এবং এই বইটি এখন পর্যন্ত পাঠক মহলে সর্বাধিক আলোচিত ও সমাদৃত।
এই বইটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে ভাষার শাব্দিক অর্থের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, বইটিতে মূল আরবি বইয়ের হুবহু অর্থ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যার ফলে পাঠকরা অনুবাদ বই পড়লেও মূল লেখক এর চিন্তা ভাবনার সাথে একটা মেলবন্ধন তৈরী করতে পারবে।
তবে এর একটি খারাপ দিক ও রয়েছে আর সেটি হচ্ছে এর ফলে বইটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সাধারন পাঠকদের পড়া ও বোঝা অনেকটা কঠিন করে দিতে পারে। কেননা বইটির শাব্দিক অর্থ ঠিক রাখতে বইটিতে এমন অনেক শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো স্বাভাবিক ভাবে বাংলা ভাষায় খুব বেশি ব্যবহৃত হয় না। একজন সাধারন পাঠক হয়ত কখনোই এমন কোন শব্দ শোনেনি।
বইটির শুরুতে এমন কঠিন শব্দের ব্যবহার কিছুটা বেশি তবে বইটির প্রথম ৭০-৮০ পৃষ্ঠার পর থেকে এরকম কঠিন শব্দের ব্যবহার তুলনা মুলক কম। তাই অনেকেই পরামর্শ দেয় যে প্রথম ৭০-৮০ পৃষ্ঠা পড়ে পরার জন্য অর্থাৎ সৌভাগ্যময় জন্ম ও পবিত্র জীবনের চল্লিশ বছর
এই অধ্যায় থেকে পড়া শুরু করা।
এবং পুরো বই শেষ করে প্রথমের পৃষ্ঠা গুলো পড়া। এতে করে পুরো বইটি শেষ করা সহজ হবে। ইনশাল্লাহ।
তাছাড়া, আরো একটি বিষয় যেটি লক্ষনীয় সেটি হচ্ছে বইটিতে সাহিত্য রসের আদিক্য খুব ভালো ভাবেই লক্ষ করা যায়। এটিরও কারণ মূলত বইটিতে শাব্দিক অর্থের দিকে গুরুত্ব দেওয়া যার ফলে বইটিতে আলাদা করে সাহিত্যরস যোগ করা সম্ভব হয়নি। আপনার যদি বই পড়ার অভ্যাস না থাকে তাহলে বইটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়া কিছুটা কষ্ট সাধ্য হতে পাড়ে।
এছাড়া বাকি সব দিক যেমন বইটির ছাপা, পৃষ্ঠা, বইটির ডিজাইন সবকিছুই অনেক ভালো ও মানসম্মত।
আর রাহিকুল মাখতুম (সমকালীন প্রকাশন)
সমকালীন প্রকাশনীর এই বইটি অনুবাদ করেছেন আবুল হাসানাত কাসিম, রিফাত মাহমুদ, আল-আমিন ফেরদৌস ও মুহাম্মাদ ফয়জুর রহমান।
এই বইটি একেবারেই নতুন অনুবাদ করা হয়েছে, 2023 সালে এটির প্রথম সংস্করন প্রকাশিত হয়েছে। তবে এরই মধ্যে বইটি পাঠক সমাজে অনেক ভালো সারা ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির অসংখ্য পাঠক বইটি পড়ে এর প্রশংসা করছে। শুধু সাধারন পাঠকই নয় অনেক আলেমরাও এই বইটির ভাষা, ব্যকরন, শব্দ চয়ন ইত্যাদির প্রসংশা করছেন।
এই বইটির বিশেষ দিক হচ্ছে বইটি সকল শ্রেনীর পাঠকদের জন্য অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় সহজ করে লেখা হয়েছে। বইটিতে খুব বেশি কঠিন কোন শব্দ বা ব্যকরন ব্যবহার করা হয়নি। যার ফলে বইটি সব ধরনের পাঠকদের জন্য উপযোগী হবে। পাঠকরা খুব সহজে কোন শিক্ষক, বা ডিকশনারির সাহায্য ছাড়া বইটি পড়তে পারবে এবং এর থেকে শিক্ষা নিতে পারবে।
বইটিতে অনুবাদকগন অনেক সাহিত্যরস দেওয়ার চেস্টা করেছেন যেটা আপনি পড়লে খুব সহজেই বুঝতে পাড়বেন। ফলে বইটি পড়তে আপনার বিরক্ত বোধ হবে না। অনেক ক্ষেত্রেই এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ সেই বিষয়টায় আপনি ভুলে যাবেন। আপনি যদি বই পড়তে খুর বেশি একটা পছন্দ নাও করেন তবুও বইটি পড়তে আপনার খুব বেশি সমস্যা হবে না। ইনশাল্লাহ।
তবে বইটি আর রাহিকুল মাখতুম বইয়ের অনুবাদ গ্রন্থ হলেও হুবহু শাব্দিক অর্থ মেনে অনুবাদটি করা হয়নি। যার ফলে বইটি হয়ত আপনাকে মূল বই এর স্বাদ দিতে পারবে না এবং আপনি মূল লেখকের চিন্তা ভাবনার সাথে খুব বেশি একটা মেলাতে পারবেন না।
এছাড়া বাকি সব দিক যেমন বইটির ছাপা, পৃষ্ঠা, বইটির ডিজাইন সবকিছুই অনেক ভালো ও মানসম্মত।
বই দুটির মুখোমুখি তুলনা
লেখার দিক দিয়ে
চলুন বই দুটোর মধ্য থেকে একটু অংশ নিয়ে বই দুটোর লেখার পার্থক্য টুকু বোঝার চেষ্টা করিঃ
বইঃ আর রাহীকুল মাখতূম বা মোহরাঙ্কিত জান্নাতী সুধা (তাওহীদ প্রকাশনী)
শিরনামঃআরবের অবস্থান
'আরব' শব্দটি 'বালুকাময় প্রান্তর' উষর ধুসর মরুভুমি বা লতাগুল্ম তৃণশষ্যবিহীন অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই বিশেষ এক বিশিষ্টগত অর্থে আরব উপদ্বীপ এবং সেখানে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের জন্য এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বইঃ আর রাহিকুল মাখতুম (সমকালীন প্রকাশন)
শিরনামঃ আরব ভূখন্ডের আয়তন ও অবস্থান
'আরব' সে তো এক বিশাল মরুভুমি! যত দূর চোখ যায় কেবল বালু আর বালু! দিগন্তবিস্তৃত সেই মরুর বুকে শত শত মাইল বিচরণ করেও দেখা মেলে না এক ফোঁটা সুমিষ্ট জল। নেই কোনো গাছপালা, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, সবুজ অরন্য কিংবা ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। আরব মানেই যেন ভিন্ন এক দৃশ্যপট। তবে প্রাচীনকাল থেকেই 'আরব' বলতে আরব উপদ্বীপ এবং সেখানকার স্থানীয়দের বোঝানো হয়।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তাওহীদ প্রকাশনীর বইতে লেখাটা শাব্দিক অর্থ বিবেচনা করে অনুবাদ করা হয়েছে তাই এখানে কোন প্রকার সাহিত্যরস যোগ করা হয়নি বা অতিরিক্ত কোন প্রকার উপমা প্রদান করা হয়নি। কিন্তু সমকালীন প্রকাশনীর বইটিতে এর ব্যতিক্রম করা হয়েছে। এখানে একই কথাকেই বিভিন্ন উপমা দ্বারা আরো সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা, ছাপা, ডিজাইন ইত্যাদির দিক দিয়েঃ
বইগুলোর পৃষ্ঠা বা ছাপার ব্যপারে আমি তেমন কিছু বলার মত দেখছি না কেননা দুটোতেই এই বিষয় গুলো ভালো রাখা হয়েছে। তবে একটা বিষয় যেটা বলা যায় সেটা হচ্ছে তাওহীদ প্রকাশনীর বইটির তুলানায় সমকালীন প্রকাশনীর বইটির অক্ষরগুলো কিছুটা বড় রাখা হয়েছে। এতে একটু বয়স্ক যারা তারা খুব সহজে এটি পড়তে পারবে।
সমকালীন প্রকাশনীর বইটির তুলানায় তাওহীদ প্রকাশনীর বইটি কিছুটা চিকন অর্থাৎ এর পৃষ্ঠার সংখা কম এবং লম্বা।
তবে, বই গুলোর ডিজাইন বা চোখের সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে এই বিষয়টা আসলে এক এক জনের জন্য এক রকম তবে আমি আমার কথা বলতে পারি সেটা হচ্ছে এক্ষেত্রে আমি তাওহীদ প্রকাশনীর বইটিকে এগিয়ে রাখবো।
শেষ কথা
এতো সব আলোচনার পর আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হচ্ছে আপনি যদি শাব্দিক অর্থের দিকে জোর দিতে চান বা মূল বইয়ের সাথে সর্বাধিক মিল রেখে কোন অনুবাদ পড়তে চান তাহলে আপনার তাওহীদ প্রকাশনীর বইটি নেওয়া উচিত।
আর যদি আপনি সহজ অনুবাদের একটি বই চান, যেটা আপনি খুব সহজে বুঝতে পারবেন। যার অনুবাদ মূল বইয়ের সাথে শাব্দিক অর্থের কিছুটা অমিল হলেও সমস্যা নেয় তাহলে আপনি সমকালীন প্রকাশনীর বইটি নিতে পারেন।
তবে একটি বিষয় হচ্ছে শুদুমাত্র একটি বই একবার মাত্র পড়ে নবিজি (সাঃ) এর পুরো জিবন মনে রাখা ও অন্তরে ধারন করা সম্ভব নয়। তাই আপনি শুরু করার জন্য সমকালীন প্রকাশনীর বইটি নিতে পারেন। এটি পড়ার পর আবার পরে তাওহীদ প্রকাশনীর বইটি নিতে পারেন।